প্রায় সব শ্রোতার মনেই আর্টসেলের “অনিকেত প্রান্তর” গানটির দৈর্ঘ্য ও এর প্রকৃত অর্থ নিয়ে একটি প্রশ্ন আছে, সেই প্রশ্নের জট খুলতে আর্টসেলের ভোকালিস্ট লিংকন এর ইন্টারভিউ হুবুহ তুলে দিলামঃ
আমাদের এক বন্ধু রুম্মান আহমেদ। ওর চমৎকার লেখার ক্ষমতা আছে, কিন্তু ওর চিন্তা ধারা এবং গানে শব্দচয়ন একটু ভিন্ন ধাঁচের, যাকে কঠিন বলা যেতে পারে। সে একদিন প্রায় ৪ পাতার এক লিরিক নিয়ে আমাদের চারজন-আমি,এরশাদ,সাজু আর সিজানের কাছে নিয়ে আসে। লিরিকের ল্যান্থ দেখে তো আমাদের চোখ কপালে ।এত্ত বড় লিরিকে সুরই বা কীভাবে বসাবো আর গাইবোই বা কীভাবে।
কিন্তু রুম্মান আমদের গানটির ভেতরের কথাগুলো স্পষ্ট করে বোঝালো। গানটির ভেতরকার কথাগুলো প্রত্যেক মানুষেরই মনের কথা হতে পারে। গানটির থিম আমাদের খুব ভাল লাগল। লিরিকটাতে প্রাণ দিয়ে গানে পরিণত করার এক ইচ্ছা আমাদের চারজনের মনে গেঁথে বসলো।
ইচ্ছে থাকলেই তো হবে না; ৪পাতার বিশাল লিরিকটাকে গান বানানো তো আর যা-তা কথা নয়। তখন আশার বাণী হিসেবে সিজান ভুবনবিখ্যাত ব্যান্ড ‘ড্রীম থিয়েটার’র ‘চেঞ্জ অব সিজনস’ গানটির উদারণ টানলো,ঘড়ির কাটাতে যার সময় ছিল ২৩ মিনিট। গানটা শুনে বিরক্তি তো আসেই না, বরং একটি লাইনের পর অথবা একটি কম্পোজিশনের পর আরেকটি শুনলে মনে হয় যে, ঠিকই তো, এরপর তো এইটাই হওয়ার কথা ছিল অথবা এই তালটার পর ওই তালেরই আসার কথা ছিল। মনে হলো, ২৩ মিনিটের সেই গানটি এমন বিখ্যাত হতে পারলে, রুম্মানের এই লিরিকেও গান বানানো অসম্ভভ নয়।
তো এই গানটা আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করলো। আমরা দিন-রাত এই ‘চেঞ্জ অব সিজনস’ গানটা বাজানোর চেষ্টা করতাম-বাজাতাম। এরপর প্রায় এক বছর আমরা এই গানটা নিয়ে কাজ করি। একটা সময় মোটামুটি গানটা হাতে এসে পড়লো। তখন আমরা রুম্মানের সেই ‘৪ পাতার লিরিককে’ গানে পরিণত করার উদ্যোগ নিলাম।
মূলত এরশাদ ও সেজান মিলে লিরিকটিতে একটা সুর বসালো। আমি আর সাজুও বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলাম। এবার বিরাট এ গানটা গাইবার পালা। গানটা গাইলাম; আর্টসেলের দ্বিতীয় অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক হিসেবেই গানটা রিলিজ পেলো – ‘অনিকেত প্রান্তর’।
‘অনিকেত প্রান্তর’ শব্দটির অর্থ ‘No mans’ land’। রুম্মানের লেখা ‘অনিকেত প্রান্তর’ লিরিকটি মানুষের ‘অনিকেত প্রান্তর’ বা ‘No mans’ land’র চিন্তা-ভাবনা নিয়ে লেখা। দু’দেশের মাঝখানে এমন একটি মালিকানাবিহীন জায়গা- ‘No mans’ land’ থাকে, যেখানে চলে না কারও নিয়ম-শৃংখলা, রীতি-নীতি, বিধি-নিষেধ, তেমনি প্রত্যেক মানুষের মাঝেও একটি করে ‘No mans’ land’ থাকে। সেই ‘No mans’ land’ দাঁড়িয়ে, সেই স্বাধীনতার তাড়না থেকে এই গানটি লেখা। মানুষ স্বাধীন হলেও স্বাধীনভাবে তার সব স্বপ্নকেই জীবন দিতে পারে না। কিন্তু কেবল অনিকেত প্রান্তরে দাঁড়িয়েই সে তার স্বপ্নগুলোকেই স্বপ্নে হলেও জীবন দিতে পারে। বাস্তবে হয়তো সেগুলো ‘স্বপ্নের দলা পাকানো বাসি কবিতা, নষ্ট গান’ হয়েই ঝড়ে যায়।
লিরিক্সঃ
শিরোনামঃ অনিকেত প্রান্তর
কথাঃ রুম্মান আহমেদ
কন্ঠঃ লিংকন
ব্যান্ডঃ আর্টসেল
অ্যালবামঃ অনিকেত প্রান্তর
—————————–
তবু এই দেয়ালের শরীরে
যতো ছেড়া রং, ধুয়ে যাওয়া মানুষ
পেশাদার প্রতিহিংসা তোমার চেতনার
যতো উদ্ভাসিত আলো রং
আকাশের মতন অকস্মাত নীল
নীলে ডুবে থাকা তোমার প্রিয় কোন মুখ
তার চোখের কাছাকাছি এসে কেন পথ ভেঙ্গে
দুটো মানচিত্র এঁকে দুটো দেশের মাঝে
বিঁধে আছে অনুভুতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ
তবু এইখানে আছে অবলীল হাওয়া
জানালা বদ্ধ ঘরে আসে যায়
দেয়াল ধরে বেড়ে ওঠে মধ্যরাত
তোমার ছায়ায় জমে এসে ভয়
আলোকে চিনে নেয় আমার অবাধ্য সাহস
ভেতরে এখন কি নেই কাপুরুষ অন্ধকার একা
তোমাকে ঘিরে পথগুলো সব সরে যায়
রাত্রির এই একা ঘর ঝুলে আছে শূন্যের কাঁটাতারে
দুটো মানচিত্র এঁকে দুটো দেশের মাঝে
মিশে আছে অনুভুতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ
তবু এই দুটি কাঁটাতারে, শহরের মতো করে
ভিড়ে ভরে গেছে ঘুম আমার
অচেতন কখন বেওয়ারিশ, মাটির কাছে এসে
সময়কে এপিটাফ ভেবে হাঁটু গেড়ে বসে
তবু এখানে বাতাস আসে দূরত্বের উৎসাহে
শরৎ জমে আছে ঠান্ডা ঘাসে
তোমার চোখের মাঝে দূরের একা পথ
এখানে ভাঙ্গে না দুটো দেশে
মেঘের দূরপথ ভেঙ্গে বুকের গভীর অন্ধকারে
আলোর নির্বাসন স্মৃতির মতো
অবিকল স্বপ্নঘর বাঁধা স্মৃতির অন্ধ নির্জনে
সময় থেমে থাকে অনাগতযুদ্ধের বিপরীতে
এখানে স্বরনীর লেখা নেই নাম, কোন শহীদ সড়কে
তোমার জন্য জমা থাকে শুধু স্বপ্নঘর
জানালায় ঝুলে থাকে না, শূন্যতার অবচেতন
তোমার ঘরের অন্ধ আলোয় অদেখা
এখানে নির্জন
অনিকেত প্রান্তর
তবু তোমার ভাঙ্গা স্মৃতি, ছেঁড়া স্বপ্ন, দোমড়ানো খেলাঘর
ছেঁড়া আকাশ ভাঙ্গা কাঁচে
আলো আর অন্ধকার তোমার
তোমার দেয়ালে কত লেখা, মানুষের দেয়ালে দেয়াল
বেড়ে ওঠে কাঁটাতার, এখানে মহান মানচিত্রের ভাগাড়
তোমার শূন্য ঘরে ভরা স্মৃতি
জড়ো পাথরে লেখা নামশহীদ স্বরনী, জানালার বাইরে
ভেসে গেছে দূরের আকাশ
বিঁধে আছি সময়ের কাঁটাতারে
বিঁধে আছো ছেঁড়া আকাশের মতো তুমি
তোমার স্বপ্নের, দলাপাকানো
বাসি কবিতা, নষ্ট গানে
তোমার জানালার বাইরে শূন্য আকাশ
তবু অনিকেত এই প্রান্তরে
এখানে এখনো শরতের প্রচুর বাতাসে
সবুজের ঘ্রানেভরে আছে অন্ধকারে ঘর তোমার
দেয়ালে এখন শুধু মৃত্যুর মৃত রেখাপাত
তোমাকে কড়া নাড়ে স্মৃতিরা ভাঙ্গা স্বপ্ন
ঘুমের মতো নেশাময় কত
কত শিশু কত
আলোর মশাল নিভে গেছে
নিভে গেছে কত অচেনা ভয়
তোমাকে এখন অপরিণত এক অচেনা স্মৃতি মনে হয়
তোমার জানালার বাইরে শূন্যে
দূরের স্বপ্নঘর, ঝুলে আছি নির্জনতায়
মৃত্যু কি অনিকেত প্রান্তর ?
RELATED NEWS
বিজয়ের গান | মুক্তির গান
শিরোনামঃ আমার সোনার বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পূর্ণ লিরিক্সঃ এখানে শিরোনামঃ বিজয় নিশান উড়ছে ঐ শিল্পীঃ সমবেত সংগীত (মূল সংগীত- সুজেয় শ্যাম) গীতিকারঃ শহীদুল হক খান সুরকারঃ সুজেয় শ্যাম সম্পূর্ণ লিরিক্সঃ এখানে শিরোনামঃ একটি বাংলাদেশ গীতিকারঃ নঈম গওহর সুরকারঃ অজিত রায় শিল্পীঃ সাবিনা ইয়াসমিন সম্পূর্ণ লিরিক্সঃ এখানে শিরোনামঃ জয় বাংলা বাংলার জয় শিল্পীঃ মোহাম্মদ আবদুল জব্বার গীতিকারঃ […]
Read Moreমহীনের ঘোড়ারা- দ্য ঘোড়া’স
মহীনের ঘোড়াগুলি আমার প্রিয় একটি ব্যান্ড। তাঁদের গানের কথা, সুর, গায়কী -সবই ভালো লাগে। তাঁদের নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরু করি খাপছাড়া ভাবে। প্রথমে তাঁদের নিজস্ব অ্যালবাম(সত্তরের দশকের) নিয়ে কিছু লিখলাম (আমার আগের পোস্ট দ্রষ্টব্য)। আজ লিখব মহীনের ঘোড়াদের নিয়ে। আর ব্যান্ডের ইতিহাস, খুঁটিনাটি তথ্য-এইসব নিয়ে লিখব আরেকদিন। আরেকদিন হয়তোবা লিখব তাঁদের “আবার বছর কুড়ি” পর […]
Read More“লাল পাহাড়ির দেশে যা”- একটি কবিতার গান হয়ে ওঠা
“লাল পাহাড়ির দেশে যা” এই গানটি নিয়ে দেখলাম অনেক দ্বিমত। কেউ বলছে এইটা অর্নবের গান। কেউ বলছে ভূমি’র। আবার কেউ বলছে লোকগীতি। দ্বিধা ভাঙবার এবং সত্য কিছু তথ্য জানাবার উদ্যেশ্যে লিখলাম। একটি কবিতার গান হয়ে ওঠা এবং অজস্র গানপ্রেমী মানুষের মন জয় করার কিছু ঘটনা। “একটি গাছ। নাম তার মহুয়া। ইংরেজীতে Madhuka Latifolia-যা বাংলা, […]
Read Moreশিরোনামহীন ছেড়ে দিলেন তুহীন!
“প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি জানালায় হাসিমুখ হাসিমুখে আনন্দধারা তুমি চেয়ে আছো তাই, আমি পথে হেঁটে যাই হেঁটে হেঁটে বহুদুর বহুদুর যেতে চাই” সেই মায়াভরা কন্ঠ কি আর শোনা যাবে ‘শিরোনামহীন’ এর সঙ্গে? ১৯৯৬ সালের কথা। ইচ্ছে ছিল মনের সব সুর ভাসিয়ে দেওয়ার। সঙ্গী ছিল একটি অ্যাকুস্টিক গিটার। কীভাবে যেন তাঁর খোঁজ পেয়ে যায় আরো […]
Read Moreনায়ক রাজ – বেঁচে থাকুন আমাদের অন্তরে
একদিকে সংসার চালানোর টাকা জোগাড় করা, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ছোট্ট একটা ক্যারেক্টারের জন্য ছুটছি আমি। দেখা করলাম মণি বোসের সঙ্গে। এহতেশাম, মোস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, সৈয়দ আওয়ালসহ অনেকের সঙ্গে। কেউ পাত্তা দিলেন না। যখন আমি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলাম তখন বেশ কিছু পরিচালকের ছবিতে ছোট ছোট কিছু চরিত্রে অভিনয় করেছি। ১৯৬৫ সালে […]
Read More